১৪ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৬ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

রূপগঞ্জের ডুবন্ত গ্রাম

admin
প্রকাশিত জুলাই ২৪, ২০২০
রূপগঞ্জের ডুবন্ত গ্রাম

Sharing is caring!

রূপগঞ্জের ডুবন্ত গ্রাম

 

 

ফয়সাল আহমেদ,রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানে যেন প্রতিটি গ্রামের মেঠো পথের কথা প্রকাশ পায়। যে পথে প্রকৃতি আনমনে খেলা করে। গ্রামের মানুষেরা ওই পথের মতোই সহজ-সরল। পথহীন গ্রাম কল্পনাতীত। মেঠো পথ ধরে হেটে হেটেই গাঁয়ের চাষির ধান শুকানো আঙ্গিনার খোঁজ মেলে। অনেকেই ধারনা করতে পারে, উন্নত রাষ্ট্রের গ্রামগুলোর পথ আরও সুন্দর, আরও পরিচ্ছন্ন, আরও নিরাপদ। কিন্তু গ্রাম আছে পথ বা রাস্তা নেই এমনটা কারও ভাবনায় নেই, এটা নিশ্চিত। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় পথ ছাড়া গ্রাম খুঁজে পাওয়া গেছে রূপগঞ্জে। এখানে রয়েছে এমন বেশ কয়েকটি গ্রাম, যেখানে কোনো সড়ক পথ নেই, আছে শুধু জলপথ। 

 

বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে যাতায়াতের কত আধুনিক প্রদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে। কিন্তু অবহেলিত ৫টি গ্রামের মানুষ আজও উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও চোখে দেখেনি। আধুনিক ডিজিটাল যুগে এখনও এই সব গ্রামের লোকেরা বর্ষাকালে নৌকা ব্যাতিত ঘর থেকে বের হতে পারেন না। বালুরপাড় গ্রামের কাজী সামসুউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামীল সরকার ক্ষমতায়। আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। তাই শেখ মজিবের নৌকাকেই আকঁড়ে আছি ডিজিটাল যুগেও। দাসের কান্দি গ্রামের তাজউদ্দিন মিয়া বলেন, ভোটের সময় এলে নেতারা সব করে দিবেন বললেও ভোট চলে গেলে বেমালুম সব ভুলে যান তারা। নেতা গেল, নেতা এলো, বিএনপি গেল আওয়ামীলীগ এলো, আমাদের ভাগ্যের কোনই পরিবর্তন হলো না। যেই সেই-ই রয়ে গেলাম আমরা।

 

নেই শহরের কোনো কোলাহল, গাড়ির ধোঁয়া, ভেপু আর চাকচিক্যময় আলোকসজ্জা। কারণ ওইসব এলাকায় কেউ ইঞ্জিনচালিত গাড়ি চালায় না। যাদের গাড়ি আছে তারা বাহিরে গাড়ি রেখে নৌকায় করে গ্রামে প্রবেশ করেন। এসব গ্রামের বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট দ্বীপের মধ্যে যার চারপাশ দিয়ে জলের প্রবাহ চলছে। গ্রামের মূল যোগাযোগ ব্যবস্থা জলপথ হওয়ায় একমাত্র বাহন নৌকার খুব কদর রয়েছে গ্রামগুলোতে। কবির ভাষায় বলতে হয়, বাঁচতে হলে লাঙ্গল ধর, আবার এসে গাঁয় (গ্রাম)। গ্রামের উন্নয়ণ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই সবার্গ্রে গ্রামের উন্নয়ণ করতে হবে।

 

 

পিরুলিয়া গ্রামের মলিন্ড চন্দ সরকার বলেন, পিরুলিয়া গ্রামে কোন রাস্তা-ঘাট, গ্যাসের ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের সাথে কেউ আত্বীয়তা করতে চায় না। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিপন মিয়া বলেন, রাস্তা না থাকায় বর্ষাকালে প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারি না, এতে লেখা পড়ার প্রভুত ক্ষতি হচ্ছে। চর্তুদিকে পানি, মধ্য খানে গোটা কয়েক বাড়ি, তারই মাঝখানে বসত করে আদম নর-নারী। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি । কোথায় রাস্তার কোন ছিটে-ফোটা নেই।

 

ডুবন্ত গ্রামগুলো দেখলে যে কারো মনে হবে পানিতে ভাসমান গ্রাম। প্রতিটি ঘাটেই বাধাঁ থাকে ছোট-বড় এক বা একাধিক নৌকা। ওই সব এলাকার যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা- আক্ষেপ করে এ কথাগুলো বলছিলেন শীতল সরকার। ৬ নং ওর্য়াডের নির্বাচিত মেম্বার আব্দুল হাই বলেন, আমার ওর্য়াডের যে সব এলাকায় রাস্তা-ঘাট, গ্যাস, বিদ্যুত নেই, খুব দ্রুতই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।

 

প্রায় ৫০ বছর আগে থেকে বালুনদীর ঘাটে একটিমাত্র নৌকা দিয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, চাকরিজীবি ও হাটবাজারের হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত পারাপার হচ্ছে।সেতুর অভাবে নৌকায় পারাপারের সময় প্রায়ই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা।এছাড়া রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নিতে সমস্যা ও কোনো সস্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটলে প্রশাসনের লোকজন দ্রুত এলাকায় আসতে পারেন না।জনদুর্ভোগ চরমে উঠলেও যেন দেখার কেউ নেই।

 

বর্তমানে ঘাটের মাঝি নিতাই জানান, ৩০ বছর ধরে আমি এই ঘাটের মানুষের পারাপারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।ধানের সময় ধান-চাল, পাটের সময় পাট, গমের সময় গম বাড়ি বাড়ি থেকে তুলে মানুষকে পারাপার করে আমার সংসার চলছে কোনমতে। গৌরনগর এলাকার মোহাম্মদ আলী বলেন, ভাল যাতায়াতের ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের সাথে অনেকে আত্মীয় পর্যন্ত করতে চায় না।

 

বালুরপার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণ গোপাল সরকার জানান, রাস্তা-ঘাটের অভাবে ছাত্রছাত্রীরা বর্ষাকালে বিদ্যালয়ে আসতে পারেনা।নৌকা ছাড়া এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া যায় না।সব সময় নৌকা পাওয়া যায় না।তাই ছাত্রছাত্রীরা সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না।

 

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতিক) বলেন, ইতিমধ্যে অনেক এলাকার রাস্তাঘাট, গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। বাকি যে অল্প সংখ্যক এলাকার যোগাযোগ সমস্যা রয়েছে তা-ও খুব শিঘ্রই সমাধান করা হবে। তিনি আরও বলেন, সবার সহযোগিতা নিয়ে গোটা রূপগঞ্জকে আমি রূপের নগরীতে পরিনত করব, ইনশাআল্লাহ।

 

এলাকাবাসীরা জানান, বালুনদীর এই ঘাট দিয়ে বাঘবাড়ী,কায়েতপাড়া, চানখালী,পিরুলিয়া, নয়ামাটি এ ৫টি গ্রামের প্রায় দশ হাজার মানুষ প্রতিদিন নৌকা করে যাতায়াত করছে।

 

এছাড়াও প্রাইমারী স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা,এতিমখানা, হাইস্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বাজারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার লোক নৌকা দিয়ে প্রতিদিন পারাপার হয়ে থাকে।