Sharing is caring!

জামরুল ইসলাম রেজা ছাতক থেকে,
অসচ্ছল পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন নিয়ে সোনার হরীণের আশায় সমুদ্রপথে ইতালি যেতে চেয়ে দালালের খপ্পরে পরে সর্বস্ব হারিয়েছেন সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মুনিরগাতি গ্রামের শিপন আহমদ। সম্প্রতি তিউনেশিয়া থেকে উদ্ধার হওয়া ১৭জন বাংলাদেশীদের একজন তিনি। সোমবার দুপুরে মা বাবার কাছে ফিরেছে শিপন।
জানা যায়, শিপন আহমদ পেশায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক। তার পরিচিত লুৎফুর রহমান তাকে সমুদ্রপথে ইতালি পৌছে দেবে বলে কথা দিয়েছিলো। কিন্তু শিপনকে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে লুৎফুর রহমানসহ দালালরা কৌশলে আদায় করে নেয় ১০লাখ টাকা। লুৎফুরের পিতা জমির আলী শিপনের পরিবারের কাছ থেকে কয়েক দফায় এই টাকা নেন বলে অভিযোগ করেন শিপন আহমদেও পরিবারের সদস্যরা।
ইতালি যাবার লক্ষে সমুদ্র জলে ৩ সপ্তাহের অধিক সময় ভাসতে ভাসতে অবশেষে তিউনেশিয়া হয়ে বেঁচে ফিরেছেন শিপন। এই পরিবারের কাছে নিখোঁজ ছিল শিপন।
শিপনের কোন খবর না পাওয়ায় দুঃচিন্তায় পাগলপ্রায় ছিলেন তার মা -বাবা। সোমবার দুপুরে শিপন তার নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। তার মা মিনারা বেগম সন্তানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শিপনকে দেখতে তার বাড়িতে জড়ো হন স্থানীয় উৎসুক জনতা। এসময় সাংবাদিকদের ভ্রমনের বিষয়ে শিপন জানায়, তিউনেশিয়া থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করাহয় এই শর্তে যে আমরা বাড়িতে ফিরে আসবো, আমরা সবাই বাড়িতে ফেরার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। বিদেশে যাওয়ার সব শখ গত ৩ সপ্তাহেই মিটে গেছে। অবস্থা এমন ছিলো যে বাঁচার জন্য অনেকে নিজের প্রস্রাব পাণ করেছে গত কয়েক দিন। আর এক দিন থাকলে আমরা হয়তো মরেই যেতাম, আমি আমাদের দূতাবাসকে ও সেখানকার আইন শৃংস্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহরর মেহেরবাণীতে আমরা বেঁেচ গেলাম।
শিপন আরো বলে, আমি সামান্য লেখাপড়া করেছি। জীবন-জীবিকার তাগিদে সিএনজি চালিয়েছি । আমার পরিচিত লুৎফুর রহমান নামে একজন লিবিয়া গিয়েছে, সে প্রায়-ই আমাকে ফোনে করে বলতো বিদেশে নিবে। আমি যাতে টাকা পয়সা রেডি করি সেজন্য তাগদা দিতো। অভাবের সংসার বদলাতে চেয়েছিলাম। আমাদের অসচ্ছলতা আর থাকবেনা ভেবেছিলাম। লোকে না জানলেও আমি কষ্ট করেই চলতাম। তাই এটাকে একটা সুযোগ মনে করেছি। কিন্তু জমি বন্ধক রেখে গরু বিক্রী করে মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে টাকা এনে এমনটা হবে সেটা কোনদিন চিন্তা করিনি’।
লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার পর আমাকে আটকে রেখে টাকা নেয়া হয়েছে। মারধর তো করতো, লিবিয়া থেকে ইতালি নিবে বলে আরও ৩ লাখ টাকা নিয়েছে আমার বাড়িতে ফোন করে। আমার কাছ থেকে সব মিলিয়ে লুৎফুর ও তার বাবা জমির মিলে ১০ লাখ টাকা নিয়েছে। কিন্তু ক্ষতিপুরণ তো চাইতে পারবো না, জমির আলী দালাল হলেও এই এলাকায় তার অনেক প্রভাব। এর জন্য হয়তো কোনদিন ওদের বিচারও হবেনা। পুলিশের কাছেও যেতে ভয় হচ্ছে। কারণ দালালের লোকজন রাস্তায় আমাকে মেরে ফেলবে।
শিপন বলে আমাকে বড় জাহাজে করে পাঠানোর কথা ছিলো। সে শর্তে টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মতো আরও ৭৩জনকে নিয়ে সাগরের পাড়ে একটা ছোট নৌকায় উঠিয়ে দিলো দালালরা। এটা এতোই ছোট ছিলো যে তাদের পরিকল্পনা ছিলো আমরা যেনো সাগরের মাঝখানে ডুবে মওে যাই। কিন্তু আল্লাহ বাঁিচয়ে রেখেছেন। প্রত্যেকটা দিন মানুষ চিৎকার করে কাঁদতো। কিন্তু এই কান্না শোনার মতো কেউ ছিলো না। ২সপ্তাহ আমরা কিছু খাইনি। চিন্তা করতাম আর কোনদিন হয়তো মায়ের কাছে আসতে পারবো না। বড় ভুল করেছি অনুসুচনা হতো। আল্লাহর কাছেই বিচার চাইতাম যেনো দালালদের বিচার করেন।
এদিকে সম্পদের সব হারিয়ে গেলেও নিজেদের ছেলে ফিরে আসায় হৃদয় খুশিতে ভরে উঠেছে শিপনের বাবা হেলাল মিয়া ও মা মিনারা বেগমের। তবে তারা সরকারের কাছে এই দালাল চক্রের দৃষ্টান্তমুলক বিচার দাবি করেন । শিপনের মা মিনারা বেগম বলেন, জমি জামা বিক্রি করে জমি বন্ধক দিয়া ছেলেরে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছি। কিন্তু দালালরা আমার ছেলেরে মারার চেষ্টা করেছে। এতো টাকা নিয়া গেছে, আমারে ঠকাইছে, আমি এর বিচার চাই।
হেলাল মিয়া বলেন গত মার্চ মাসে শিপনকে লিবিয়া নেয়ার কথা বলে টাকা নেয় মায়ের কোল গ্রামের দালাল লুৎফুর রহমান ও তার পিতা জমির আলী। পরে শিপনকে লিবিয়া নিয়ে আটকে রেখে তার কাছ থেকে ২লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। পরে ইতালি নেয়ার কথা বলে গত ২১ মে আরও ৩লাখ টাকা চেয়ে নেয় লুৎফুরের পিতা জমির আলী। টাকা নেয়ার পর লুৎফুর আমাদের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ছেলের কোন খোঁজ পাইনি। পরে টিভিতে খবরে জানলাম আমার ছেলে উদ্ধার হইছে। এই ঘটনায় আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই।
শিপন অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসায় খুশি তার ভাই শোয়েব আহমেদ রিপন। সে বলে, আমার ভাই যে আমাদের মাঝে এসেছে সেজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আমার মা বাবা রোজ কান্না কাটি করতেন। মা রাতে ঘুমাননি কতোদিন। ভাইয়ের চিন্তায় অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন।
প্রতারনা ও অত্যাচারের শিকার শিপন আহমেদ আর কোন বাংলাদেশীকে সমুদ্রপথে বিদেশ না যেতে আহবান জানিয়েছে। শিপন বলে, সারাদিন যদি কথা বলি তবুও বুঝাতে পারবোনা যে আমি কতো বড় বিপদে ছিলাম। এমন অবস্থা আল্লাহ আর যেনো কাউকে না দেখান। যারা বিদেশ যেতে চান তাদের কাছে আমি করজোড়ে অনুরোধ করি তারা যেনো মায়া বাবার কাছে থাকেন। নিজের পরিবারের সাথে অভাব অনটনও কষ্ট করে থাকা অনেক সুখের। কখনোই নিজের পরিচিত কারো মাধ্যমে যেনো নৌ পথে কোন দেশে না যান।
এ বিষয়ে লুৎফুর রহমান ও তার পিতা জমির আলীর আলীর সাথে যেগাযোগের চেষ্ঠা করে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।