১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

জন্মান্ধ কমলগঞ্জের কন্ঠশিল্পী সাধন তাঁতির স্বপ্ন পূরণ হবে তো ?

admin
প্রকাশিত জানুয়ারি ৮, ২০২০
জন্মান্ধ কমলগঞ্জের কন্ঠশিল্পী সাধন তাঁতির স্বপ্ন পূরণ হবে তো ?

Sharing is caring!

বিশেষ প্রতিনিধি, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) থেকে :

কুরমা থেকে ঘুরে এসে।।
কমলগঞ্জ উপজেলার এক অদম্য মেধাবী জন্মান্ধ কন্ঠশিল্পী সাধন তাঁতি । কানে না শুনলে বিশ্বাষ করা কঠিন যে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত চা-বাগানের অভাবী সংসারে চরম অবহেলা অনাদরে বেড়ে উঠা জন্মান্ধ এ্‌ই কিশোরের কন্ঠে বিধাতা কত সুর ঢেলে দিয়েছেন।গানের শিক্ষকের কাছে একদিনও যে তালিম নেওয়ার সুযোগ পায়নি সে কি করে রপ্ত করতে পারলো কঠিন এই বিষয়টিকে । পুরো বিষয়টি আসলে অবাক হওয়ার মতো। লোকমুখে অদম্য মেধাবী এই জন্মান্ধ কন্ঠ শিল্পীর কথা শুনে তার কন্ঠে গান শোনার লোভ সামলাতে না পেরে ছুটে গিয়েছিলাম তার বাড়ীতে ।তার সাথে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার হদয়ে জমে থাকা নানা স্বপ্ন ও কষ্টের কথা। অদম্য মেধাবী জন্মান্ধ কন্ঠশিল্পী সাধন তাঁতির বাড়ী মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের ন্যাশনাল টি কোম্পানীর কুরমা চা বাগানের ফাঁড়ি বাগান বাঘাছড়ায়। 

১৯৯৮ সালের ১০ই জানুয়ারি বাগানের এক দরিদ্র অসহায় শ্রমিক পরিবারে তার জন্ম। তার বাবার নাম কানু তাঁতি আর মা হলেন যমুনা তাঁতি ।

 

দুই ভাই বোনের মধ্যে সাধন ছোট।বাবা কানু তাঁতিও ছিলেন একজন জন্মান্ধ কন্ঠশিল্পী । তার সুরের খ্যাতি ছিল দেশে-বিদেশে।পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশ শহর, আগরতলা, মরাছড়া,আমপাশা, মোহনপুর, কমলপুর প্রভৃতি এলাকায় কোন অনুষ্টান হলেই ডাক পড়তো কানু তাঁতির।তাঁর সুরের মূর্ছনায় পাগল ছিলেন এই অঞ্চলের মানুষগুলো।আর দেশের ভিতরে বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের আনাচে কানাচে বিচরণ ছিল শিল্পী কানু তাঁতির । তার গান শুনেন নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া হবে কঠিন।।১ছেলে,১মেয়ে আর স্বামী- স্ত্রী এই চার জনের ছোট সংসার চলতো জন্মান্ধ কানু তাঁতির গানের মাধ্যমে প্রতিদিন যা আয় রোজগার হতো তা দিয়ে। টান পোড়েনের সংসারে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলনা। অন্ধ ছেলে বাচঁবে কি করে । ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় নীরবে নিভৃতে তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তো জল।বরাবরই সাহস যুগিয়েছেন তার সহধমর্নী যমুনা তাঁতি। স্বামীকে পরামর্শ দেন ছেলেকেও গান শিখানোর জন্য। যেই কথা সেই কাজ ।পরদিন থেকে শুরু হলো গানের তালিম।বাবা গাইতেন আর জন্মান্ধ পুত্র সাধন তার শ্রবণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পিতার গাওয়া গান মুখস্ত করতেন।পরে তা বাড়ীতে সবাইকে গেয়ে শুনাতেন।
একসময় শুরু হয় পিতার সাথে তার হাট-বাজারে যাওয়া ।সঙ্গে তাদের একমাত্র যন্ত্র করতাল।সকাল বেলা নম্বরে কাজে যাওয়ার আগেই বাপ-বেটাকে খাইয়ে বিভিন্ন হাট বাজারে পাঠিয়ে দিতেন ।
পিতা-পুত্র দুজনেই নিজ কণ্ঠে হাতে কর্তাল বাজিয়ে হাঁটে, ঘাটে, মেলায়, রাস্তায়,মানুষের বিনোদন করে যা আয় রোজগার হতো তাতেঁ বেশ ভালই চলছিল তাদের টান পেড়েনের সংসার। কিন্তু বিধি বাম। কপালে সইলো না তার সে সুখ।মাত্র ৮ বছর বয়সে তাকে হারাতে হলো জন্মদাত্রী মাকে ।মায়ের শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে মারা গেলেন বড় বোন ।বিধাতার অভিশাপে ১৬ বছর বয়সে অণ্ধের যষ্টি শেষ সম্বল পিতাও চলে গেলেন পরপারে। অসহায় হয়ে পড়লেন জন্মান্ধ সাধন। জীবিকার তাগিদে নিরুপায় হয়ে বাবার দেখানো সেই পথ ধরে হাটা শুরু করতে হলো সাধনকে। বাইরের কোন গুরু নয়;তাঁর গানের গুরু বলতে ছিলেন একমাত্র তাঁর বাবা । ছোটবেলা বাবার কাছ থেকে যেটুকু শেখা সেটুকুই ছিল তার সম্বল ।এই সম্বলকেই পুঁজি করে রাস্তায় রাস্তায় তিনি নিত্যদিন গান গেয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে যাচ্ছেন।যার যা খুশি হয় তা দেয় কারো প্রতি কোন অনুযোগ নেই তার।তার এই অসহায়ত্বে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন ৯ নং ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ইউপি সদস্য।তাদের সহায়তায় তিনি এখন পেয়েছেন সরকার প্রদত্ত প্রতিবন্ধী ভাতার সুযোগ। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর যার আশ্রয়ে এই গুনী শিল্পীর দিনকাল অতিবাহিত হচ্ছে তিনি হলেন তারই কাকা সার্জন তাঁতি । নিজের সন্তানের মতো প্রতিপালন করে যাচ্ছেন অন্ধ ভ্রাতাষ্পুত্রকে।
সাধনকে কখনো বুঝতে দেননি তার মা-বাবা না থাকার বিষয়টি।সাধনও ঠিক তেমনি নিজের পিতার মতো শ্রদ্ধা করে তাকে । যা আয় রোজগার তার মধ্যে নিজের পকেট খরচ বাদে বাকী সবটুকুই তুলে দেন কাকার হাতে।
বাগানের শ্রমিক তার কাকা সার্জন তাঁতি ও একজন বড়মনের মানুষ।প্রথম আলাপচারিতায় তিনি কোনভাবেই বুঝতে দেননি সাধন তার ভাতিজা। তাকে তিনি তার ছেলে হিসাবেই পরিচয় দেন। এমন নিকট আত্বীয় সমাজে ক‘জন আছে।অবনত মস্তকে তাকে অভিবাদন না জানিয়ে পারলাম না।

সাধন তাঁতির সাথে কথা বলে জানা গেলো, অন্ধ হলেও চলাফেরায় তাঁর কোনো কষ্ট নেই। হাতের লাঠির সাহায্যে একা একাই ঘুরে বেড়ান পথ থেকে পথে।পরিচিত মুখ হিসাবে এলাকায় সকলেই তাঁকে স্নেহ করেন। তাঁর আসা যাওয়ার ভাড়া নেন না পরিচিত যানবাহন চালকরা । প্রতিদিন কারো না কারো মাধ্যমে যোগাড় হয়ে যায় খাবারের টাকাও। এলাকার মানুষের এই অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা তুলে ধরতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এই গুণী শিল্পী।
সীমাহীন কষ্টের মধ্যে তার দিনাতিপাত জেনেও জানতে চাইলাম তার জীবনের কষ্ট কি?
প্রথমেই মা বাবার কথা স্বরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। চোখের জল মুছতে মুছতে সাধন বললেন, – ‘ভাই আমি পথে পথে গান গাই।মানুষ আমার গান হুনিয়া খুশী অয়, বাহবা দেয়। দুই এক টেকা করিয়া বখশিষ দেইন। ইলা যে টেকা পাই তা দিয়া একজন মাইনষর বাচাউ দায় ’।
তিনি কারো করুণার পাত্র হয়ে বাঁচতে চান না ।সবার সহযোগীতায় তিনি তার এই মেধাকে কাজে লাগিয়ে একজন বড় মাপের কন্ঠ শিল্পী হতে চান।তিনি তার কন্ঠের গান ছড়িয়ে দিতে চান সারা দেশে।
তার বাবার অন্তিম ইচ্ছা ছিল-ছেলে বড় হয়ে একজন নামী দামী শিল্পী হয়ে এলাকার ও পরিবারের মুখ উজ্বল করবে। কিন্ত আজো তার পক্ষে পিতার সেই স্বপ্ন কে সাথর্ক করা সম্ভব হয়ে উঠেনি । তবে তিনি আশাবাদী বড় শিল্পী না হলেও অন্তত নিজ অঞ্চলের মানুষ একদিন তাকে চিনবে একজন ভাল কন্ঠ শিল্পী হিসাবে।
অলাপচারিতার ফাকে কিছুটা ক্ষোভও ঝাড়লেন মিডিয়ার উপর। তিনি মনে করেন যদি মিডিয়া কর্মীরা তার প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়াতেন তাহলে তার স্বপ্নপুরণের পথটি আরও সুগম হয়ে উঠতো।