১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারির সেই কালোদিন আজ

admin
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯
ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারির সেই কালোদিন আজ

Sharing is caring!

অভিযোগ ডেস্ক ::  আজ ২৬ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৫ সালের এইদিনে তৎকালীন সেনা সমর্থিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক জারি করেন ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বা দায়মুক্তির অধ্যাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের খুনিদের দায়মুক্তি দিতে জেনারেল জিয়া পাশ করেন ইনডেমনিটি আইন। আইনের শাসন, সাংবিধানিক অধিকার, বিচার পাবার অধিকার রূদ্ধ করে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি “এক কালো অধ্যায়’। দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

“ইনডেমনিটি – এক কালো অধ্যায়’ এই ঘোষণার দাবিতে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আজ (২৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯ সাড়ে নয়টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এতে সংহতি জানাবেন বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষক, ছাত্র, চারুশিল্পী, স্বনামধন্য টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের তারকারা, বুদ্ধিজীবীরা এবং মুক্তিযোদ্ধারা। “ইনডেমনিটি – এক কালো অধ্যায়’ শীর্ষক আলোচনা সভা শুরু হবে বেলা ১১ টায় (দুপুর) জাতীয় প্রেসক্লাবের মানিক মিয়া হলে।

উল্লেখ্য, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমান স্বাক্ষরিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের প্রথম অংশে বলা হয় , ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

এরপর নানা নাটকীয়তা ও মর্মান্তিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হন। সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আইন প্রশাসক হন আর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রহসনের ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংশোধনীটি পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল সংক্রান্ত আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করা হয়, তাদের রিপোর্টেই প্রকাশ পায় এই কালো আইনটি বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই। এ প্রেক্ষিতে এরপর তৎকালীন আইনমন্ত্রী এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ নামে একটি বিল উত্থাপন করেন।১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সংসদে পাস হয় বহুল সমালোচিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল। এরই মধ্যেমে জাতি ২১ বছরের কলঙ্ক মুক্ত হয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়।

এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।

১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।

২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতি দায়মুক্ত হয়।