Sharing is caring!
পীরগঞ্জে টিটিসি-তে ৩ সাংবাদিকের ওপর হামলায় গ্রেফতার ১, বাকিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে
লোকমান ফারুক,( রংপুর):- বিকেলের আলো তখন ধীরে ধীরে নেমে আসছিল কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পুরনো দেয়ালজুড়ে। নীরব প্রাঙ্গণ, এক পাশে পড়ে থাকা বিকল মাইক্রোবাস, আর তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কৌতূহল। ঠিক সেই মুহূর্তেই নেমে আসে হঠাৎ ঝড়-ক্যামেরার লেন্সের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিন সাংবাদিকের ওপর তীব্র আঘাতের ঝড়।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা। সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)। গত ১২ মার্চ ২০২৫ সালের বিকেল—-স্থানীয় তিন সাংবাদিক আব্দুর রহিম, রতন মিয়া ও আশিকুর রহমান সেখানে গিয়েছিলেন নিয়মিত অনুসন্ধানী তথ্য সংগ্রহে। অধ্যক্ষকে না পেয়ে তারা ফেরার পথে খেয়াল করেন, প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত একটি বিকল মাইক্রোবাস টানছে কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থী। সাংবাদিকরা ভিডিও ধারণ শুরু করলে মুহূর্তেই চারদিক ঘিরে ফেলে ১০–১২ জন যুবক। তাদের হাতে লাঠি, মুখে রাগ, চোখে আতঙ্কের ছায়া। সেকেন্ডের ব্যবধানে কেড়ে নেওয়া হয় মোবাইল ফোন, শুরু হয় মারধর। ধুলো উড়তে থাকে, গলার চিৎকার মিলিয়ে যায় মেশিনের শব্দে। আহত সাংবাদিকদের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে স্থানীয়রা ছুটে আসে। পরে তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
ঘটনার আট মাস পর—রোববার গভীর রাতে পুলিশ মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর শালপাড়ার আজাদুল ইসলামের ছেলে আশিকুর রহমানকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন,’অভিযোগ ও ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে ঘটনাটিতে জড়িত আসামি আশিকুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে তৎপরতা চলছে।’
গ্রেফতারকৃত আশিকুর রহমানকে সোমবার সকালে আদালতে পাঠানো হয়। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার সময় যাদের নেতৃত্বে হামলা হয়েছিল—বাঁধন, আব্দুল মান্নান, শাহজাহান ও সোহাগ—তারা এখনো অবাধে চলাফেরা করছেন। একাধিক সূত্র বলছে, এদের মধ্যে কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ। পুলিশি তদন্ত তাই অনেকের চোখে ‘ধীর’ ও ‘নির্বিকার’।
টিটিসি সূত্রে জানা গেছে, সাংবাদিকরা যে ভিডিও ফুটেজ ধারণ করেছিলেন, তাতে প্রতিষ্ঠানের কিছু অনিয়মের ইঙ্গিত ছিল—অচল গাড়ির ক্রয়, প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের অপচয়, এমনকি অর্থনৈতিক দুর্নীতিরও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন,
‘ওরা হয়তো ভয় পেয়েছিল—যদি সেই ভিডিও বাইরে যায়, তাহলে অনেক কিছু প্রকাশ পেয়ে যাবে।’

এই ভয়ই কি হামলার মূল কারণ?—এই প্রশ্ন এখন ঘুরছে পীরগঞ্জের সাংবাদিক মহলে। মামলার বাদী সাংবাদিক রতন মিয়া বলেন, ‘আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম জানতে গিয়েছিলাম। পরিবর্তে পেলাম হামলা আর হুমকি। এখনো যারা মূল পরিকল্পনাকারী, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।’
এদিকে স্থানীয় সাংবাদিক সংগঠনগুলো বলছে, সাংবাদিকদের ওপর হামলা মানে জনগণের চোখে আঘাত—যারা তথ্য জানার অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তাদের ভয় দেখানো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপরাধ।
ঘটনার পর প্রশাসন ও টিটিসি কর্তৃপক্ষের অবস্থান ছিল ‘সতর্ক নীরবতা’। হামলার নিন্দা কেউ প্রকাশ্যে করেননি। অথচ টিটিসি একটি সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যার তত্ত্বাবধান স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে।
প্রশ্ন জাগে—যখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়, তখন প্রশাসনের দায় এড়ানো যায় কীভাবে? নীরবতা কি কৌশল, নাকি ভয়ের অন্য নাম?
এখনো সেই টিটিসি প্রাঙ্গণে গেলে দেখা যায় বিকল মাইক্রোবাসটি, নড়াচড়া নেই, তবু যেন তার দেহে রয়ে গেছে সেই দিনের শব্দ। বাতাসে মিশে আছে সেই বিকেলের উত্তেজনা, সেই ভাঙা ক্যামেরার স্মৃতি, আর এক অদৃশ্য প্রশ্ন—সত্যের খবর নিতে গিয়েও যদি সাংবাদিক নিরাপদ না থাকেন, তবে নিরাপত্তা কার হাতে?
৩ নভেম্বর ২০২৫