১২ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৭শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

রংপুরে নোটিশ ছাড়া উচ্ছেদ: পাঁচ পরিবার গৃহহীন, আদালতে ন্যায়বিচারের লড়াই

admin
প্রকাশিত অক্টোবর ১৪, ২০২৫
রংপুরে নোটিশ ছাড়া উচ্ছেদ: পাঁচ পরিবার গৃহহীন, আদালতে ন্যায়বিচারের লড়াই

Sharing is caring!


Manual8 Ad Code

নিউজ ডেস্ক, রংপুর

রংপুর মহানগরীর তাজহাট থানার আশরতপুর কোর্টপাড়ার এক শান্ত মহল্লায় হঠাৎ নেমে আসে গর্জন—লোহার হাতুড়ির শব্দ, চিৎকার, আর ভাঙনের ধুলো। সেই দুপুরে পাঁচটি পরিবারের জীবন যেন এক মুহূর্তে গুঁড়ো হয়ে যায়। কোনও নোটিশ ছিল না, ছিল না আদালতের নির্দেশ। ছিল শুধু একদল মানুষের হঠাৎ আগমন, আর চোখের সামনে ভেঙে পড়া ঘরবাড়ি।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, আশরতপুরের এই জমির মালিকানা নিয়ে কাহিনি দীর্ঘদিনের। কেরামত প্রামাণিকের মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে—হবিবর ও নকিবর, এবং এক মেয়ে ছইমন নেছা—উত্তরাধিকার সূত্রে ১১৮.৫ শতাংশ জমির মালিক হন।

Manual1 Ad Code

২০০৯ সালে ছইমন নেছার উত্তরাধিকারীরা তাঁদের অংশের ২১ শতাংশ জমি বৈধভাবে বিক্রি করেন।

ক্রেতারা দলিল, খাজনা ও খারিজের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেই জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেন, সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করান, গাছ লাগান—একটি ছোট মহল্লা তৈরি হয় ধীরে ধীরে। সবকিছু চলছিল শান্তভাবে—যতদিন না ৪ সেপ্টেম্বরের দুপুরটি আসে। সেদিন দুপুরে আশরতপুরের বাতাসে এক ধরনের উদ্বেগ ঘুরছিল। লোকজন বলছিল,’কিছু লোক ট্রাক নিয়ে এসেছে, ঘরের পাশে জড়ো হচ্ছে।’ তারপরই শুরু হয় হট্টগোল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি মব তৈরি করে হঠাৎ এসে ঘরবাড়ি ভাঙতে শুরু করেন। কেউ কোনও সরকারি কাগজ দেখাতে পারেনি, কেউ আদালতের আদেশের কপিও বের করতে পারেননি।

ভুক্তভোগীরা চিৎকার করছিলেন, শিশুদের কোলে নিয়ে মহিলারা ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন। কেউ কাঁদছিলেন, কেউ অনুনয় করছিলেন, কেউ শুধু তাকিয়ে ছিলেন নিজের ভাঙা বাড়ির দিকে—নিস্তব্ধ আর অসহায়।

উচ্ছেদে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একজন, শিক্ষক মিজানুর সরদার রিপন, চোখে জল নিয়ে সাংবাদিকদের বললেন— “নোটিশ পেলে অন্তত মালামাল, টাকা-পয়সা, গয়না কিছু উদ্ধার করতে পারতাম।’ কিন্তু বিনা নোটিশে ঘরবাড়ি ভেঙে দিল। আমরা কিছুই বাঁচাতে পারিনি।’ এখন তারা আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউ ভাড়ার ঘরে, কেউ অস্থায়ী টিনের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন।

রিপন জানান, পাঁচটি পরিবার আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। ‘আমরা বিজ্ঞ আদালতে মামলা করেছি। প্রশাসনের কাছে দাবি, তদন্ত হোক, দোষীদের বিচার হোক, আর আমরা যেন আবার ঘরে ফিরতে পারি।’

Manual3 Ad Code

ভুক্তভোগীদের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন— “একটি কুচক্রি মহল মব সৃষ্টি করে বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করেছে। এটি শুধু সম্পত্তির বিরোধ নয়, এটি নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন।’ ভুক্তভোগীরা এই দেশের নাগরিক, তারা ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। আমি তাদের সেই লড়াইয়ে পাশে আছি।’ তার কথায় আইনের গাম্ভীর্য আছে, কিন্তু লুকিয়ে আছে ক্ষোভও।

Manual5 Ad Code

অন্যদিকে, প্রতিপক্ষ মোছাঃ রওশন আরা বেগম দাবি করেন, “১৯৯১ সালের মধ্যে ৫২১৯/৫২২০ দাগের জমি দলিল মূলে ক্রয় করি। কিন্তু পুরো জমি দখলে না পেয়ে আদালতে মামলা করি। আদালতের রায়ে জমি ফেরত পাই।’ রওশন আরা বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তারা জমি পুনর্দখল করেছেন।’ তবে সেই দখলের দিনে কোনও প্রশাসনিক উপস্থিতি বা স্থানীয় পুলিশের তদারকি ছিল না—এমনটাই বলছেন এলাকাবাসী।’ রংপুরের অভিজ্ঞ আইনজীবীরা বলছেন, “বাংলাদেশে সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ ছাড়া জোরপূর্বক উচ্ছেদ সম্পূর্ণ বেআইনি।

Manual8 Ad Code

‘ এমনকি রায় কার্যকর করতে হলেও জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।’ কিন্তু আশরতপুরে সেই প্রক্রিয়া মানা হয়নি। নোটিশ ছাড়া উচ্ছেদ, প্রশাসনের নীরবতা—সব মিলিয়ে একটি প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে—এই শহরে আইন কাগজে লেখা, না মাটির ওপরও কার্যকর? সন্ধ্যা নামার পর ধ্বংসস্তূপে ফিরে এলাম। ভাঙা দেয়ালের পাশে এক শিশুর জুতো পড়ে আছে, কাদা লেগে শুকিয়ে গেছে। ঘরের ভেতর থেকে ভাঙা কাঠের আলমারির একটি অংশ উঁকি দিচ্ছে—যেন নীরবে অভিযোগ জানাচ্ছে কারও কাছে। এক নারী বললেন, ‘এখানেই আমার বিয়ের শাড়ি ছিল, এখন শুধু ইট, খোয়া আর বালু।’

তার কণ্ঠে অনুযোগ নেই, আছে অবিশ্বাস—যেন ভাবতেও পারেননি, নিজের ভিটে মাটিথেকে এভাবে একদিন উচ্ছেদ হতে হবে। রংপুর সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কেউ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শুধু বললেন— ‘ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ কিন্তু তদন্ত শুরু কবে হবে? উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলো কি পুনর্বাসন পাবে—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো অনিশ্চিত। রাতের শেষে আশরতপুর এখন নিস্তব্ধ। ভাঙা দেয়ালের ওপরে চাঁদের আলো পড়েছে, দূরে শুনতে পাওয়া যায় আজানের সুর।

ভুক্তভোগীদের চোখে এখন আদালতের কাগজই একমাত্র আশার প্রতীক। তারা বিশ্বাস করেন, আইনের শক্তি হয়তো ধীরে চলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় ন্যায়ের দোরগোড়ায়। প্রশ্ন শুধু একটাই— কতগুলো রাত পার করতে হবে এই পাঁচ পরিবারকে, যতদিন না সেই ন্যায়বিচার সত্যি এসে দরজায় কড়া নাড়ে?

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code