Sharing is caring!
তিস্তার বুকের ঘর -হাসিনা বেগমের জীবনের মতো ভাঙা-আবার গড়া
লোকমান ফারুক, (রংপুর):-ভোরের আলোয় নদীর বুকটা তখন কুয়াশায় ঢাকা। নরম আলোয় দেখা যায়, কাঁধে মাটির কলস নিয়ে হাঁটছেন হাসিনা বেগম। তিনি শাওলার চরের মানুষ। প্রতিদিন ভোরে অনেক দূর থেকে পানি আনেন, যেন দিনটা অন্তত তৃষ্ণাহীন কাটে। ‘তিস্তা আমাদের মা, আবার রাক্ষসও,’ বলেন হাসিনা, নদীর দিকে তাকিয়ে। ‘যখন হাসে, তখন জমি দেয়। যখন রাগ করে, তখন সব নিয়ে যায়।’
ভিটে মানে স্মৃতি, নদী মানে অনিশ্চয়তা
দশ বছর আগেও হাসিনাদের ঘর ছিল গাবুর হেলানের চরে। নদী গিলে ফেলেছে সেই ভিটে, জমি, এমনকি তার স্বামীকেও। ভাঙনের রাতে স্রোতের টানে নৌকা উল্টে যায়—তখন থেকেই হাসিনা একাই তিন সন্তান নিয়ে টিকে আছেন। ‘আমার জীবনও নদীর মতো, যেখানে ভাঙন আছে, আবার নতুন চরও ওঠে,’ বললেন তিনি ধীরে।
হাসিনার পাশে দাঁড়ানো তার বড় ছেলে রাশেদ এখন মাছ ধরে সংসার চালায়। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে দু’বছর হলো। কারণ, দারিদ্রতা তার স্কুল জীবনটা কেড়ে নিয়েছে।
২৫টি চরে একই গল্প
রাজারহাট উপজেলার শাওলার চর, অতিদেবের চর, ঠুটাপাইকরের চর, বিদ্যানন্দের চর, হযরত খার চর, বিশ-বাইশের চর, আজম খার চর, শিখা খাওয়ার চর, হরিণচরণের চর, চর হংশধরসহ প্রায় পঁচিশটি চরেই একই দৃশ্য—জমি যখন থাকে, তখন ফসল; যখন নেই, তখন ভিটেমাটি পিঠে নিয়ে অন্য চরে পাড়ি।
একজন কৃষক, ঠুটাপাইকরের চর থেকে আসা আবদুল খালেক বলেন, ‘আমরা মানুষ না, নদীর ভাসমান ধানগাছ। যতক্ষণ পানি কম, ততক্ষণই টিকে আছি।’
অধিকারহীন জীবনের নীরব সংগ্রাম
চরবাসীর কাছে নাগরিক অধিকার একরকম বিলাসিতা। শিক্ষার আলো পৌঁছায় না, চিকিৎসা মানে কুসংস্কার, আর ভোটার তালিকায় নাম উঠতে বছর লাগে।
বিদ্যানন্দের চরের সুমনা আক্তার বলেন, ‘আমরা নদীর মানুষ—নদী যেমন চুপ, আমরাও চুপ। কিন্তু ক্ষুধা তো চুপ থাকে না।’
প্রশাসনের চোখে ‘অস্থায়ী মানুষ’
রাজারহাট উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চরের উন্নয়ন প্রকল্প আছে, কিন্তু নদীর অবস্থার কারণে টেকসই কিছু করা যাচ্ছে না।’ তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, নদী শাসন প্রকল্পের অর্থ আসে, কিন্তু নদী তেমনি থাকে—বরং চরের মানুষ আরও ভাসমান হয়। স্থানীয় শিক্ষক মফিজুল হক বলেন, ‘এখানে মানুষকে সাহায্য নয়, অধিকার দিতে হবে। চরবাসী রাষ্ট্রের বাইরে নয়, রাষ্ট্রেরই ভেতরে বন্দী।
নদীর মতোই টিকে থাকা জীবন
সন্ধ্যায় তিস্তার বুক রুপালি আলোয় ঝলমল করে। হাসিনা বেগম তখন চুলায় হাঁড়ি চাপাচ্ছেন, পাশে ছোট মেয়ে নাফিসা নদীতে পাথর ছুড়ছে। ‘তিস্তা যদি ভাসায়, আবার মাটিও দেয়। আমরা সেই মাটিতেই ঘর বাঁধি’,বললেন হাসিনা। তিস্তার স্রোত ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, কিন্তু তার বুকের ভেতর জন্ম নিতে থাকে নতুন চর। ঠিক যেমন হাসিনার জীবনে—প্রতিটি ভাঙনের ভেতরই আছে নতুন এক জীবনের বীজ।
তিস্তা কেবল নদী নয়, এক চলমান উপন্যাস—যেখানে প্রতিটি চর, প্রতিটি মানুষই একেকটি অধ্যায়।
তারিখ: ৩০/১০/২০২৫